ছোটবেলা থেকেই খেলা পাগল কৃষ্ণার আকর্ষণ ফুটবলের প্রতি। সারাক্ষণ ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলত সে। দিনের বেশির ভাগ সময় খেলা নিয়ে বাড়ির বাইরে থাকতো বলে মা প্রায়ই বকা দিতেন। লেখাপড়ায় অমনোযোগী কৃষ্ণা ফুটবল নিয়ে ছেলেদের সঙ্গে মাতামাতি করায় লোকে নানা রকম কটাক্ষ করতেন।
অতিষ্ঠ হয়ে বল কেড়ে নিয়ে কেটে ফেলতেন তার মা। একাধিক বার বন্ধ করে দিয়েছেন খেলা। তবুও দমাতে পারেনি কৃষ্ণার খেলা। খেলতে না দেওয়ায় কৃষ্ণা খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে অনশন করেছেন। পরে বাধ্য হয়ে খেলার সুযোগ দিয়েছেন বাবা মা।
নেপালের কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে শিরোপা জিতে ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশ। দেশের হয়ে ৩ গোলের মধ্যে দুটোই করেছেন টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার মেয়ে সেই কৃষ্ণা রানী সরকার।
উপজেলা শহর থেকে ৭ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত উত্তর পাথালিয়া গ্রাম। প্রত্যন্ত এই গ্রামে দারিদ্রতার ছাপে জর্জরিত একটি টিনের বাড়ি। ছোট এই বাড়িটি ঘিরেই এখন গর্ব আর ব্যাপক উচ্ছ্বাস। কারণ এ বাড়িটি সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে জোড়া গোলের মালিক কৃষ্ণা রানী সরকারের।
বাবা বাসুদেব সরকার ও মা নমিতা রানী সরকারের দুই সন্তানের মধ্যে কৃষ্ণা বড়। ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি কৃষ্ণার জন্ম। ফুটবলে হাতেখড়ি ২০১০ সালে উপজেলা পর্যায়ে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব আন্তঃপ্রাথমিক ফুটবল টুর্নামেন্টে। সে সময় কৃষ্ণার নেতৃত্বে নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উত্তর পাথালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় উপজেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়।
ওই টুর্নামেন্টে কৃষ্ণা সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হওয়ায় সূতি ভিএম পাইলট মডেল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শরীর চর্চা শিক্ষক গোলাম রায়হান বাপনের নজরে পড়েন এ ফুটবল কন্যা। তার অসাধারণ ক্রীড়া নৈপুণ্য দেখে শরীর চর্চা শিক্ষক আগ্রহ নিয়ে কৃষ্ণার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর কৃষ্ণাকে তার স্কুলে বিনা বেতনে ভর্তি করান। সেখান থেকেই ফুটবল চর্চার অবাধ সুযোগ পায় সে।
কৃষ্ণার ফুটবল নৈপুণ্য আর বিশেষ ভূমিকায় জাতীয় স্কুল ও মাদ্রাসা ফুটবল প্রতিযোগিতা ২০১১, ২০১২ এবং ২০১৩ সালে পরপর ৩ বার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। পরবর্তীতে জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৪ বালিকা ফুটবল দল গঠন করা হলে কৃষ্ণাসহ একই স্কুল থেকে আরও দুই কিশোরী ফুটবলার বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৪ বালিকা ফুটবল দলেও জায়গা করে নেন।
২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক ফুটবলে কৃষ্ণার নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো শিরোপা জেতে বাংলাদেশ। পরের বছর একই টুর্নামেন্টেও শিরোপা ঘরে তোলে বাংলাদেশ। তবে সেই দলে বয়সের কারণে ছিলেন না কৃষ্ণা।
একই বছর ঢাকায় হওয়া এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের বাছাইয়ে গ্রুপ পর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়ে চূড়ান্ত পর্বে উত্তীর্ণ হয় বাংলাদেশের মেয়েরা। সেই দলের গর্বিত অধিনায়কও ছিলেন কৃষ্ণা রানী সরকার। একই সঙ্গে সেই আসরে ৮ গোল করে দলকে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দেন এ ফুটবল বিস্ময় কন্যা।
২০১৭ সালে কৃষ্ণার নেতৃত্বেই থাইল্যান্ডে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের মূল পর্বে খেলার গৌরব অর্জন করেছে লাল-সবুজের দল। ২০১৭ সালের প্রথম দিকে ভারতে হওয়া সাফ ফুটবলে রানার্সআপ হয় বাংলাদেশ। যে দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন কৃষ্ণা।
কৃষ্ণার মা নমিতা রানী সরকার বলেন, আমরা খুবই গরিব। এক সময় টাকার অভাব ও গ্রামের মানুষের কটুকথার কারণে মেয়েকে ফুটবল খেলতে বারণ করেছিলাম। তারপরও কৃষ্ণার ইচ্ছার কাছে কটূক্তি করা মানুষজন হেরে গেছে। সে এখন দেশের গৌরব। সবাই তার প্রশংসা করছে। তবে অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি হচ্ছে না আমাদের। এক মেয়ের ওপর নির্ভর করে সংসার খরচ ও ছেলের পড়াশোনা চলে।
কৃষ্ণার বাবা বসুদেব সরকার বলেন, ছেলে খেলোয়াড়রা অনেক টাকা বেতন পায়। অথচ মেয়েরা সামান্য সম্মানী পায়। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও দেশসেরা হয়েছে। সুতরাং তাদের কেন ন্যায্য বেতনভাতা দেওয়া হবে না।
কৃষ্ণার হাতেখড়ি দেওয়া কোচ গোলাম রায়হান বাপন বলেন, কৃষ্ণা খুব দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। কঠোর পরিশ্রম এবং ইচ্ছা শক্তি থাকার ফলে সে আজ দেশসেরা ফুটবলার হতে পেরেছে। যা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। তাকে দেখে স্কুল এবং উপজেলার অনেক ক্ষুদে ছেলে-মেয়েরা খেলাধুলায় আগ্রহী হচ্ছে।
কোচ বলেন, সোনার মেয়েরা আমাকে একটি ট্রফি উপহার দিয়েছে। আমার কোচিং ক্যারিয়ারের সেরা অর্জন এটা। আমরা দক্ষিণ এশিয়ার সেরা দল। মেয়েরা দেশের মানুষকে সেরা উপহার দিয়েছে।
কৃষ্ণা রানী সরকার বলেন, এত বড় অর্জনের অংশ হতে পেরে খুবই ভালো লাগছে। এ অর্জন বাংলাদেশের সব মানুষের।