শিরোনাম

প্রকাশঃ Thu, Jun 15, 2023 4:49 PM
আপডেটঃ Sun, Apr 28, 2024 10:16 PM


মার্কিন ভিসা নীতি : নড়ে উঠেছে রাজনীতির মাঠ

মার্কিন ভিসা নীতি : নড়ে উঠেছে রাজনীতির মাঠ

বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে আমেরিকা বেশ সন্দিহান এবং এরই প্রেক্ষিত সম্প্রতি মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণা করা হয়েছে। মূলত আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্টু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক একটি কার্যকর নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করতেই মার্কিন ভিসা নীতির এ আয়োজন। সুষ্টু নির্বাচনে বাধা দিলে ভিসা দিবেনা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের একটি বিশেষ ধারা [২১২ (এ) (৩) (সি) ('৩ সি') ] অনুযায়ী এই নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করা হয়েছে। নতুন এই ভিসা নীতি ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন।




গত ৩ মে বাংলাদেশ কে আনুষ্ঠানিক জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিষয়টি আলোচনায় আসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ২৪ মে তার টুইটে পোস্ট করার পর। পরবর্তীতে এই বিষয়ে  বিস্তারিত বিবৃতি মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর তাদের ওয়েব সাইটে প্রকাশ করে, এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দফতের মূখপাত্র ম্যাথু মিলার নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনেও বাংলাদেশের নির্বাচন কে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি চালুর বিষয়টি তুলে ধরেন।



অত্যন্ত স্পষ্ট করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিবৃতিতে বলেন- গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কাজের মধ্যে রয়েছে : ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, জনগণকে সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা, এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার চর্চাকে সহিংসতার মাধ্যমে বাধাদান, এর পাশাপাশি রাজনৈতিক দল, ভোটার, নাগরিক সমাজ, এবং গণমাধ্যমকে তাদের মতামত প্রচার করা থেকে বিরত রাখতে বিভিন্ন ধরণের কর্মকাণ্ড নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার পদক্ষেপের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। কোন প্রক্রিয়ায় কারা এই ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়তে পারেন বিষয়টি আরো বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। চ্যানেল আইকে দেওয়া 'তৃতীয় মাত্রা' অনুষ্ঠানের বিশেষ পর্বে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- আমি খুব স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমরা আজ কারো বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিইনি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী (ব্লিঙ্কেন) একটি নতুন নীতি ঘোষণা করেছেন। যার আওতায় বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্টু নির্বাচন বাধাগ্রস্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত করার সঙ্গে যারা দায়ী বলে যুক্তরাষ্ট্র সরকার মনে করবে তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন ভিসায় বিধিনিষেধ আরোপ করা যাবে। তিনি হতে পারেন সরকার, বিচার বিভাগ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা বিরোধী দলের সদস্য। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, দক্ষিণ এশিয়া ও বিশ্বজুড়ে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার জন্য গণতন্ত্রের সুরক্ষা অপরিহার্য। 


মার্কিন ভিসা নীতি এটা যে শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই ঘোষণা করা হয়েছে এরকম নয়,  সম্প্রতি ১৫ মে নাইজেরিয়ার জন্য এই ভিসা নীতি ঘোষণা করা হয়েছে। এর আগে উগান্ডা, সোমালিয়া, নিকারাগুয়া, ও বেলারুশ এই চারটি দেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্র একই পদক্ষেপ নেয়। নাইজেরিয়া ও উগান্ডার নির্বাচনের পর এসব দেশের সরকারি কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ভিসা নীতির আলোকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচন আরো সাত মাস বাকী, যার অর্থ দাঁড়ায় আগামী দ্বাদশ নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র অনেক বেশি সিরিয়াস, যারাই অবাধ, সুষ্টু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে বা বিপক্ষে ভূমিকা রাখবে সে সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যুক্তরাষ্ট্র কোন সংকোচ করবে না। ভিসা নীতি ঘোষণার পর থেকেই বাংলাদেশে উক্ত বিষয়গুলো নজরদারি শুরু করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যা ম্যাথু মিলার সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট করে দিয়েছেন। 


মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পর থেকেই নড়ে উঠেছে রাজনীতির মাঠ, বেশ সরগরম শুরু হয়েছে রাজনীতির অঙ্গনে। সকল মহলে আলোচিত ইস্যু এখন মার্কিন ভিসা নীতি। সব রাজনৈতিক দল ই এই বিষয়ে দলীয় ও ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। কেননা প্রদত্ত ভিসা নীতি নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও সকল রাজনৈতিক দলের জন্যই প্রযোজ্য এবং সকলের জন্য বিশেষ সতর্ক বার্তা। মার্কিন ভিসা নীতি নিয়ে সব দলই ইতিবাচক বক্তব্য দিচ্ছে, ক্ষমতাসীনদের জন্য এই ভিসা নীতি মাথা ব্যাথার কারণ হলেও তা বিরোধীদের উপর চাপিয়ে সর্বমহলে তা সার্বজনীন করার চেষ্টা করা হচ্ছে তাদের পক্ষ থেকে। যার ফলে সরকার দলীয় মন্ত্রী, এমপিরা আত্মবিশ্বাসী বক্তব্য দিচ্ছে, আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন- যারা আন্দোলনের নামে নির্বাচন সামনে রেখে বাসে আগুণ দিবে, বাস ভাংচুর করে তারা পলিটিক্যাল ভায়োলেন্সে আছে, কাজেই তাদের খবর আছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে বলেন- যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি বাংলাদেশের জনগণের দীর্ঘ দিনের অবাধ ও সুষ্টু নির্বাচনের দাবির ই প্রতিধ্বনি। গণতন্ত্র মঞ্চ এক বিবৃতিতে বলেন- মার্কিন নতুন ভিসা নীতি বাংলাদেশিদের জন্য অবমাননাকর। তারা বলছে- জবরদস্তি করে ক্ষমতা টিকিয়ে রেখে নিয়মতান্ত্রিক পথে সরকার পরিবর্তনের রাস্তা বন্ধ করে দেওয়ায় এরকম অপমানজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও মিডিয়ার মাধ্যমে দেখতে পাই, জাতীয় পার্টি, সিপিবি  সহ প্রায় সকল মতের রাজনৈতিক দল আলোচিত এই বিষয়ে যার যার বক্তব্য তুলে ধরেছে। সরকার ইতোমধ্যে বিরোধী দলগুলোকে মিছিল মিটিং এর সুযোগ দিচ্ছে, পূর্বের ন্যায় কোন বাধা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীকে বিক্ষোভ সমাবেশ করতে দেওয়া মার্কিন ভিসা নীতির প্রভাব মাত্র।


মার্কিন ভিসা নীতি নিয়ে সরকার দলীয় নেতা ও মন্ত্রীরা ইতিবাচক বক্তব্য দিলেও বিষয়টা সরকার ও আওয়ামীলীগকে চিন্তায় ফেলেছে, কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে- আন্দোলনের মাঠে বিএনপি সহ সরকার বিরোধী সব দল। অবাধ, সুষ্টু, ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবীতে তারা একের পর এক কর্মসূচী দিয়ে নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছে। বিরোধী দলগুলোর কর্মসূচী নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং প্রশাসনকে বিভিন্ন সময় ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। এখন মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার কতটা কঠোর হতে পারবে? কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসন সরকারের কতটা অনুগত থাকে সেটি এখন ক্ষমতাসীনদের বড় ভাবনার বিষয়। বিএনপি তত্ত্বাবধয়াক সরকারের ইস্যুতে আন্দোলন করছে সে আন্দোলনে বিএনপি সহিংস হলে যেমন তা আমেরিকার নজরদারিতে পড়বে আবার নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে ক্ষমতা প্রয়োগ করে বাধা সৃষ্টি করলে তা মার্কিন এ্যাম্বাসির নজরদারিতে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। ভিসা নীতির আওতায় কারা বা কোন প্রতিষ্ঠান পড়বে সে বিষয়ে সরাসরি নাম উল্লেখ না থাকলে কে বা কারা এর আওতায় পড়তে পারে সে বিষয়ে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে বিচার বিভাগ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ।  বিএনপি সহ অন্যান্য বিরোধী দল রাজপথে আওয়ামীলীগ সহ পুলিশকে প্রতিপক্ষ মনে করে এবং বারবার তাদের মিছিল মিটিংএ পুলিশ বাধা দেয় বলে অহরহ অভিযোগ বিএনপি সহ বিরোধী নেতারা করে থাকেন। এখন ভিসা নীতির ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেদের প্রয়োজনে সংযত থাকবে অথবা আগের মত সরকার দল কর্তৃক প্রভাবিত না হওয়াটাই প্রাসঙ্গিক।


অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সাথে অনেক বেশি সংযুক্ত।  বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে সে স্রোতে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশও এগিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা, অর্থনীতি, বিনিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি ও রপ্তানি আয় সহ সব মিলিয়ে বাংলাদেশ যে স্তরে পৌঁছেছে সেই ধারাবাহিকতা চলমান রাখতে হলে বৈশ্বিক মূল্যবোধের সাথে বাংলাদেশের সামঞ্জস্য রাখতে হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা নিশ্চিত করতে হলে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সমূহের সচ্চতা জরুরী। নিয়মতান্ত্রিকভাবে সরকার পরিবর্তনের পক্রিয়া চালু রাখতে হবে। জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচন নিয়ে যে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা সে ভীতির সংস্কৃতি দূর করতে হবে। তাহলেই বেশ্বিক মূল্যবোধের সাথে তাল মিলিয়ে চলা সম্ভব এবং কোনদেশ এসে খবরদারীর সুযোগ পাবেনা। 


অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশের বড় অংশীদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশের সবচেয়ে বেশি রপ্তানি আয় আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রবাসী আয় আসে এই দেশ থেকেই, এমনকি বছর শেষে দেখা যাবে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসবে যুক্তরাষ্ট্র থেকেই। বাংলাদেশের সাথে আমেরিকার ব্যবসায়িক সম্পর্কও সমৃদ্ধ। অপরদিকে বাংলাদেশ ভৌগলিকভাবে রাজনৈতিক সুবিধাজনক অবস্থানে আছে, সেজন্য চীনের বলয় থেকে যেন বাংলাদেশ মুক্ত থাকে সে বিষয়েও আমেরিকা বেশ মনযোগী। তাই বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন অবাধ সুষ্টু ও নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক করতে তাদের এত বড় পদক্ষেপ(ভিসা নীতি)। দিন যত যাবে রাজনীতির মাঠ তত উত্তপ্ত হবে। ঘোষণা দিয়ে আসছে আওয়ামীলীগ শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন করবে অপরদিকে বিএনপি শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাবে না, নির্দলীয় সরকারের দাবীতে আন্দোলন করছে। যে যার দাবীতে অটুট থাকলে স্বাভাবিকভাবেই দেশ সংঘাতের দিকে যাবে যা কোনভাবেই কাম্য নয়। বরং মার্কিন ভিসা নীতির ফলে রাজনীতির মাঠে যে ইতিবাচক সুর বইছে সেই সুরের বাস্তব প্রতিফলন ঘটুক সেটাই প্রত্যাশা।


লেখক

মুহাম্মদ মেহেদী হাসান

সাবেক সভাপতি (ডিবেট বাংলাদেশ)



www.a2sys.co

আরো পড়ুন