গাজায় যুদ্ধের অবসান ও বিধ্বস্ত ওই অঞ্চল পুনর্গঠনে
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি প্রস্তাব দিয়েছেন, যার বেশির ভাগ পরিকল্পনা
এসেছে তাঁর পক্ষ থেকে। সমর্থন জানিয়ে এ পরিকল্পনায় কিছুটা গতি এনেছে জর্ডান, মিসর,
কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্কের মতো শীর্ষস্থানীয়
আরব ও মুসলিমপ্রধান দেশ।
ট্রাম্পের পাশে দাঁড়িয়ে প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছেন ইসরায়েলের
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও। যদিও ট্রাম্পের প্রস্তাবে এক পর্যায়ে ফিলিস্তিনি
রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়েছে। এর আগে নেতানিয়াহু বারবার এর বিরোধিতা করেছেন। তিনি দ্বিরাষ্ট্র
সমাধান মানে না বলেও মন্তব্য করেছিলেন।
আলোচনার গতি রাখতে ট্রাম্প হামাসকে প্রস্তাবটি বিবেচনার জন্য
তিন থেকে চার দিনের সময় দিয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার বিবিসির বিশ্লেষণে বলা হয়, প্রস্তাবিত
চুক্তিটি অনেকটা জো বাইডেনের এক বছর আগের পরিকল্পনার মতো। এ সময়ের মধ্যে ফিলিস্তিনের
বেসামরিক নাগরিকদের ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, গাজায় আরও ধ্বংসযজ্ঞ ও এখন দুর্ভিক্ষ ঘটছে।
অন্যদিকে ইসরায়েলের জিম্মিদের মাসের পর মাস যন্ত্রণা ও বন্দিদশা ভোগ করতে হয়েছে।
ইসরায়েলের গণমাধ্যম জানায়, বাইডেনের ওই উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার
কারণ ছিল নেতানিয়াহু ও তাঁর মন্ত্রিসভার কট্টর মন্ত্রীদের চাপ। তারা নতুন দাবি যুক্ত
করতে চেয়েছিলেন। তবে সবকিছুর পরও যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের পরিকল্পনা প্রস্তাব একটি উল্লেখযোগ্য
মুহূর্ত। প্রথমবারের মতো ট্রাম্প যুদ্ধ শেষ করতে ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন।
গত জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে শপথ নেওয়ার
পর ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে এমন এক নেতা হিসেবে গড়ে তুলেছেন, যার সামনে না বলা কঠিন।
তাই কেউ চায় না ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মতো অবস্থায় পড়তে। জেলেনস্কি
ফেব্রুয়ারিতে ওভাল অফিসে ট্রাম্পের সঙ্গে দ্বিমত করে বিরূপ অবস্থায় পড়েন।
ট্রাম্পের প্রস্তাবের একাংশ ছিল, ইসরায়েলের পাশে একটি স্বাধীন
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র বা ‘দ্বিরাষ্ট্র সমাধান’। এটি যুক্তরাজ্য ও অন্য পশ্চিমা দেশও সমর্থন
করে। সম্প্রতি ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়ে তারা সে ধারণা পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টাও
করেছেন।
নেতানিয়াহুর দ্বিচারিতা
ট্রাম্পের প্রস্তাবিত নথিতে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার ধারণার
প্রতি সমর্থন দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বে রামাল্লাভিত্তিক
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সংস্কারের পর ‘অবশেষে ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্রের
প্রতিষ্ঠার জন্য একটি বিশ্বাসযোগ্য পথ তৈরি হতে পারে, যেটিকে আমরা ফিলিস্তিনি জনগণের
আকাঙ্ক্ষা হিসেবে স্বীকৃতি দেব।’
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ন্যূনতম সম্ভাবনার কথাও নেতানিয়াহুর
কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। অথচ তিনি হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে ইংরেজিতে
বলেছিলেন, ‘আমি গাজায় যুদ্ধ শেষ করার জন্য আপনার পরিকল্পনাকে সমর্থন করি, যা আমাদের
যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জন করবে।’ কিন্তু নেতানিয়াহু ওয়াশিংটন ডিসি থেকে ইসরায়েলে ফিরে
যাওয়ার আগে তাঁর কর্মীরা হিব্রু ভাষায় তাঁর একটি ভিডিও ধারণ করেন। সেখানে তাঁকে প্রশ্ন
করা হয়– তিনি কি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের প্রস্তাবনার সঙ্গে একমত? তখন হিব্রু ভাষায় নেতানিয়াহু
বলেন, ‘না, একেবারেই না। চুক্তিতেও এটি লেখা নেই। কিন্তু আমরা একটা কথা পরিষ্কার বলেছি।
আমরা জোরালোভাবে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে প্রতিরোধ করব।’
গাজায় যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের প্রস্তাবিত পরিকল্পনার শক্তি
হলো গতিশীলতা; অর্থাৎ দ্রুততার সঙ্গে ট্রাম্প এটি মীমাংসা করতে চাচ্ছেন। আর দুর্বলতা
হলো– পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত তথ্যের অভাব। অবশ্য এটি ট্রাম্পের কূটনীতির একটি বৈশিষ্ট্য।
ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু পরিকল্পনার যে নথিটি অনুমোদন করেছেন,
তা যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোর সমর্থনও পেয়েছে। তাতে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা
বাহিনীর (আইডিএফ) প্রত্যাহারের পর্যায়গুলো নিয়ে মোটামুটি বর্ণনা আছে। তবে যুদ্ধ বন্ধে
প্রস্তাবিত কূটনৈতিক চুক্তিগুলো কীভাবে টিকিয়ে রাখা যায়, সেটি নির্ধারণের মতো কৌশল
প্রস্তাবনায় নেই। তাই এ পরিকল্পনা কার্যকর করতে জোরালো আলোচনার প্রয়োজন হবে। আর
সেই আলোচনার টেবিলেই ট্রাম্পের পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার সুযোগ থাকবে।
ইসরায়েলের মূলধারার বিরোধী দলগুলো পরিকল্পনাকে সমর্থন করেছে।
কিন্তু নেতানিয়াহু জোটের উগ্রপন্থিরা এর নিন্দা জানিয়েছেন। তারা বছরের শুরুতে প্রস্তাবিত
‘ট্রাম্প রিভেরা’ পরিকল্পনাটি পছন্দ করেছিলেন, যাতে গাজার ফিলিস্তিনিদের অন্য দেশে
পাঠানোর কথা ছিল। ইহুদি কট্টরপন্থিরা গাজাকে ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত করতে চায়; সেখানে
ইহুদি বসতি স্থাপন করতে চায়। ফলে ট্রাম্পের প্রস্তাব মেনে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে
রাজি হলে ইসরায়েলেই কট্টরপন্থিদের তোপের মুখে পড়তে পারেন নেতানিয়াহু। আবার ট্রাম্পের
প্রস্তাব নাকচ করলে বিশ্বজুড়ে ইসরায়েলের মিত্ররা নাখোশ হতে পারে।
ট্রাম্পের পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, কোনো ফিলিস্তিনিকে জোর
করে দেশ থেকে বিতাড়িত করা হবে না। এর সমালোচনা করেছেন ইসরায়েলের কট্টরপন্থি নেতা বেজালেল
স্মোট্রিচ। হামাস চুক্তিতে সম্মত হলেও সমাধান নাও হতে পারে। নেতানিয়াহু স্মোট্রিচ ও
তাঁর জোট টিকিয়ে রাখতে আলোচনার টেবিলে হামাসের ওপর দোষ চাপিয়ে অস্থিরতা ও নাশকতা চালিয়ে
যেতে থাকবেন। ট্রাম্পের প্রস্তাবিত পরিকল্পনায় ইসরায়েল পছন্দ করে না– এমন অনেক বিষয়
আছে যেগুলো তারা মেনে নেবে না। ফলে এ গভীর সংঘাতের অবসান ঘটানো সম্ভব নাও হতে পারে।
নুর/আকাশ টিভি